Tuesday, April 16, 2013

এতিমের হক প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মুফতি আইনুল ইসলাম কান্ধলবী
এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে আল্লাহ পাক এতিমদের হক আদায়ের ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ করেছেন। কেননা প্রাক-ইসলামিক যুগে এতিমদের প্রতি জুলুম করা হতো অনেক বেশি। প্রাক-ইসলামিক যুগে বর্বরতার শিকার হতো অসহায় নারী, অনাথ এতিম, মিসকিন এবং কন্যাসন্তান। নারীদের কোনো অধিকার ছিল না সমাজে। এতিমদের ধনসম্পদ তাদের অভিভাবকরা আত্মসাৎ করে ফেলত এবং কন্যাসন্তানদের বর্বর পৌত্তলিকরা জীবন্ত কবরস্থ করত।

প্রিয়নবী (সা.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে আল্লাহপাক সমাজের এই দুস্থ, বিপদগ্রস্ত মানুষদের বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করার নির্দেশ দিলেন। ফলে মরণাপন্ন মানবতা পুনর্জীবন লাভ করল। সভ্যতার ক্রমবিকাশ শুরু হলো।
মানুষ জুলুম-অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেল। নারী পেল তার অধিকার, এতিম ফেরত পেল তার ধনসম্পদ এবং কন্যাসন্তানদের প্রতি যে নির্মম ব্যবহার করা হতো, তা বন্ধ করা হলো। পবিত্র কোরআনুল কারিমে মজলুম এতিমদের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ তাগিদ রয়েছে এবং এ সম্পর্কে অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে।

আমরা এ পর্যায়ে পবিত্র কোরআনের মহান শিক্ষার মাহাত্ম্য এবং যথার্থতার সঠিক উপলব্ধির জন্য অন্যান্য আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারি। সুরা দোহায় মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, 'সুতরাং এতিমদের ধমক দিয়ো না।' সুরা ওয়াল-ফাজরে মহান আল্লাহ ইরশাদ ফরমান, 'না কখনোই নয়, বস্তুত তোমরা এতিমদের সম্মান করো না।' সুরা বাকারায় আল্লাহপাক ইরশাদ ফরমান, 'আর লোকরা আপনাকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন তাদের কল্যাণ সাধনই উত্তম। আর এতিমদের তাদের সম্পদ দিয়ে দাও। তাদের উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে তোমাদের নিকৃষ্ট দ্রব্যকে পরিবর্তন করো না।' এভাবে পবিত্র কোরআনে ২২টি আয়াতে এতিমদের অধিকার সম্পর্কে বিশেষ তাগিদ করা হয়েছে। কেননা ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুর্গত ও জরাজীর্ণ মানবতার পরিত্রাণের জন্যই ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে। বিশ্বমানবের সার্বিক কল্যাণ সাধনই ইসলামী জীবনবিধানের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে আরো একটি লক্ষ্য অর্জিত হয়, আর তা হলো পরম করুণাময় আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভ করা। আর এটি মানুষের পরম চাওয়া এবং পাওয়া। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে হাকিমে ইরশাদ করেছেন, 'আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।' যেহেতু প্রিয়নবী (সা.)-এর ওপর আল্লাহপাকের অফুরন্ত করুণা ছিল, তাই তাঁর কিছু কর্তব্যও থাকবে এটিই স্বাভাবিক। এ জন্য আলোচ্য আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, হে রাসুল! এতিমের প্রতি আপনি কখনো কঠোর ব্যবহার করবেন না, তার মনে আঘাত লাগবে এমন কাজ করবেন না, আর এ কথা স্মরণ রাখবেন যে একসময় আপনিও এতিম ছিলেন। তদানীন্তন আরবে এতিমদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার হতো, তাদের ধনসম্পদ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা কেড়ে নিত। তাই এতিমদের হক সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের এ আয়াতে বিশেষভাবে তাগিদ করা হয়েছে। যদিও আলোচ্য আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে হজরত রাসুলে কারিম (সা.)-কে, কিন্তু উদ্দেশ্য করা হয়েছে গোটা মানবজাতিকে। যাতে এতিমদের প্রতি সঠিক ও সদয় ব্যবহার করা হয়। তাফসিরকার জুযায (রহ.) বলেছেন, আলোচ্য আয়াতে 'লা তাকহার' শব্দটির অর্থ হলো, এতিমের প্রতি কঠোর হইও না, তথা এতিমের ধনসম্পদ জবরদখল করো না, তার দুর্বলতার সুযোগে তার ধনসম্পদ কেড়ে নিয়ো না। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, মুসলমানদের সে বাড়িটি উত্তম, যে বাড়িতে এতিমের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর মুসলমানদের মধ্যে সে বাড়িটি মন্দ, যে বাড়িতে এতিমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। অন্য এক হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) দুটি আঙুল প্রদর্শন করে বলেছেন, 'আমি ও এতিমের অভিভাবক জান্নাতে এভাবে পাশাপাশি থাকব। হুজুর (সা.) তাঁর মধ্যমা এবং তর্জনী অঙ্গুলির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। (ইবনে মাজাহ ও বুখারি শরিফ) আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে এতিমদের হক আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন।
লেখক : খতিব, বায়তুল মামুর জামে মসজিদ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment